স্টাফ রিপোর্টার :
নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগকে দ্বিখন্ডিত করার চেষ্টা চলছে। তাও আবার দলের ভিতরে ঘাপটি মেরে আছে সেই চক্র! এমন মন্তব্য করেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন। তার এই মন্তব্যের পর আলোচনা তুঙ্গে উঠেছে। দলে ঘাপটি মেরে থাকা সেই কুশিলব কে বা কারা- তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্নও।
জানা গেছে, ওয়ার্ড কমিটি গঠন নিয়ে মহানগর আওয়ামী লীগে বিভাজন প্রকাশ্যে এসেছে। সভাপতি আনোয়ার হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহার প্রতি চটেছে মহানগর আওয়ামী লীগের বৃহৎ একটি অংশ।
তাদের অভিযোগ, মহানগরের ২৭টি ওয়ার্ডে মধ্যে ১৭টি ওয়ার্ড কমিটি গঠনে যোগ্যদের অবমূল্যায়িত করে তুলনামূলক অযোগ্য এবং নিষ্ক্রীয়দের নেতৃত্বে আনা হয়েছে। বিশেষ করে, এসব কমিটি গঠনে মহানগর আওয়ামী লীগের অন্যান্য দায়িত্বশীল নেতাদের সাথে সমন্বয় কিংবা আলোচনাও করা হয়নি। এমনকি, সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর নিজ এলাকা ১৬নং ওয়ার্ডের শীর্ষ পদের নেতৃত্ব নিয়েও কোনো আলোচনা হয়নি।
এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্য রেখেছিলেন সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভী এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জিএম আরাফাত। পাশাপাশি পদবঞ্চিত নেতাদের অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। আনোয়ার হোসেনকে দেওভোগে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছিলেন মেয়র আইভী। একই সাথে বন্দরের আওয়ামী লীগ নেতাদের বৃহৎ একটি অংশও আনোয়ার হোসেন ও খোকন সাহাকে বন্দরে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছিলেন। তাদের ঘোষিত কমিটির মাধ্যমে প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগকে দাফন করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছিলেন প্রতিবাদি নেতারা। পাল্টা কমিটি দেয়ারও ঘোষণা এসেছিল। এ নিয়ে আনোয়ার হোসেন ও খোকন সাহা চাপের মুখে উপনীত হয়েছিল। মহানগর আওয়ামী লীগে ফাঁটলও দেখা দিয়েছিল মোটা দাগে।
সম্প্রতি পাল্টা কমিটি জমা দেয়ারও গুঞ্জন শোনা গেছে। এরই মাঝে গত ১৭ই মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত সভায় কথা বলেছেন আনোয়ার হোসেন। তার বিরোধী অবস্থানে থাকা নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্য করে নেতিবাচক মন্তব্যও করেছেন প্রবীন এই আওয়ামী লীগ নেতা।
আনোয়ার হোসেন বলেন, ৭৫’র পর চক্রান্ত হয়েছিল, ১/১১ তে হয়েছিল, এখন আবার চেষ্টা করা হচ্ছে আওয়ামী লীগকে দ্বিখন্ডিত করার জন্য। বিভিন্ন জেলায় জেলায় আওয়ামী লীগের ইমেজ নষ্ট করার জন্য স্বাধীনতা বিরোধী চক্র এবং দলের ভিতরে ঘাপটি মেরে থাকা ষড়যন্ত্রকারী আওয়ামী লীগকে দ্বিখন্ডিত করার চেষ্টা করছে। তৃণমূল যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে, আওয়ামী লীগকে কেউ দ্বিখন্ডিত করতে পারবে না। ষড়যন্ত্রকারীদের বিষদাঁত ভেঙ্গে দিয়ে প্রমাণ করে দিবো আনোয়ার খোকনের নেতৃত্বে মহানগর আওয়ামী লীগ কতটা শক্তিশালী।’
আনোয়ার হোসেনের এই বক্তব্যের পর আলোচনা তুঙ্গে উঠেছে। দলের ভিতরে ঘাপটি মেরে থাকা ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে তিনি কাকে ইঙ্গিত দিয়েছেন- তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও অনেকেই বলছেন, আনোয়ার হোসেনের সাথে সম্প্রতি বিরোধে জড়ানো ব্যক্তিদের প্রতি এই ইঙ্গিত দিয়ে থাকতে পারেন তিনি।
এদিকে, আনোয়ার হোসেনের আরও একটি মন্তব্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। একই সভায় তিনি বলেছেন, ‘আমাকে কেউ নেতা বানায়নি। আনোয়ার হোসেন তৃণমূল থেকে উঠে এসেই নেত্রীর স্নেহভাজন হয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের কোনো নেতাই আমাকে নেতা বানায় দেয়নি। অনেকেই আমাকে মাইনাস করেছিলেন।’
তার এই মন্তব্য নিয়েও আলোচনা চলছে রাজনীতিকাঙ্গণে। কেননা, ওয়ার্ড কমিটি নিয়ে বিভেদ সৃষ্টি হওয়ার পর মেয়র আইভী বলেছিলেন, আনোয়ার হোসেন ও খোকন সাহা তার হাতে গড়া।
গত ১৬ই ফেব্রুয়ারি মেয়র আইভী বলেন, ‘শহর আওয়ামী লীগের কমিটি যেদিন হয়, সেদিন চুনকা পাঠাগারে সাবের হোসেন চৌধুরী প্রধান অতিথি ছিল। সেখানে উনি বসে বলেছেন, আপনি (আইভী) কার কথা বলেন? ওর (আনোয়ার) উপরে ছাদ নাই, আমি বললাম, না আমি পৌরসভার চেয়ারম্যান হয়েছি, আনোয়ার কাকা এই পদ চেয়েছে আমি বৃহত্তর স্বার্থে কোন একটা ছেড়ে দেব। ১১ সালে যখন আমি নির্বাচন করলাম, আপনারা জানেন আমি কিভাবে নির্বাচন করলাম। নির্বাচনে পাশ করলাম। আমার সাথে নেত্রীর কি কথা হয়েছে গণভবনে আমি জানি। ২০১১ সালে পুরা বৃহত্তর দেওভোগ আমরা একসাথে। আমরা একসাথে নির্বাচন করসি। উনি (আনোয়ার) আগেই আমাকে শর্ত দিয়েছিলো মহানগরে পদ চাইতে পারবা না। মহানগরের সভাপতি উনি আমার থেকে চাইয়া ইতোমধ্যে নিয়া নিলো। আমি বললাম আপনি পার্টি করেন। যা কথা তাই কাজ। আমি যেই কথা যারে দেই আমার জীবন গেলেও আমি তা রাখার চেষ্টা করি। আমি অন্যায়ভাবে কারো সাথে কিছু করিনা। ২০০৩ থেকে গেল ২০১১। ২০১১ থেকে আজকে ২০২৪ পর্যন্ত উনারাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ২০১১ তে কমিটির হবার পর মহানগরে আমার নামটা পর্যন্ত তারা রাখে নাই কোথাও।’
আইভী আরও বলেছিলেন, ‘মর্গ্যান স্কুলেও উনাকে (আনোয়ার হোসেন) আমি সভাপতি করসি। এটাও বাদ দেন। খোকন সাহা এবং আনোয়ার সাহেব তারা আমার হাতে গড়া। যদি উনি মুসলমানের সন্তান হয়ে থাকে তাহলে আনোয়ার কাকা বলুক উনাকে প্রেসিডেন্ট কিভাবে বানানো হয়েছে। যদি খোকন সাহা ধর্মে বিশ্বাস করে থাকে, যেই ধর্মেরই হোক যদি উনার ভিতরে মানবতা থেকে থাকে উনি দাঁড়াইয়া বলুক।’
মেয়র আইভীর এই মন্তব্য বেশ আলোচনায় এসেছিল। এরই মাঝে মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জিএম আরাফাত বলেছিলেন, আনোয়ার সাহেব আমাদের কাঁধে ভর করে রাজনীতি করেছে। তাকে যখন উত্তর মেরু থেকে বিতারিত করা হয়েছিল, তখন আমরাই তার পাশে ছিলাম।
বোদ্ধা মহল বলছেন, মেয়র আইভী এবং আরাফাতের মন্তব্যকে কেন্দ্র করেই গত ১৭ই মে অনুষ্ঠিত স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের সভায় আনোয়ার হোসেন বলেছেন, তাকে কেউ নেতা বানিয়ে দেয়নি। তবে দলের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে তিনি কাকে ইঙ্গিত দিয়েছেন, তা নিয়েই বাড়ছে আলোচনা।